শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মতামত

পদ্মা সেতুর পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে করণীয়

জামিউল আহমেদ
০২ আগস্ট ২০২২
জামিউল আহমেদ

জামিউল আহমেদ

একটি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে। অন্যটি আমার একান্ত সাক্ষাৎকার। এর আগে আমার ধারণা ছিল না বিদেশে থেকেও সে দেশের পর্যটন সম্পর্কে এতটা জ্ঞান রাখে। সঙ্গে ছিল তার বুদ্ধিদীপ্ত ও তীর্যক প্রশ্নবান। যা সত্যিই আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে এবং তার সম্পর্কে আগে যা কিছু জেনেছিলাম তার চেয়েও বেশি মনে হয়েছে।

তিশা সেন’র নানা প্রশ্নের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল আমাদের পর্যটন সম্পদ সুন্দরবন নিয়ে। সুন্দরবনের দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে এবং এক তৃতীয়াংশ ভারতে। ভারত সুন্দরবনকে বিশ্বে এমনভাবে তুলে ধরছে যেন সুন্দরবন ভারতেরই। তার সঙ্গে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে পর্যটন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। যা দেশের পরিচিতির পাশাপাশি পর্যটন খাতেও আয়ের অঙ্ক বাড়াচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশ এত বিশাল একটি বনাঞ্চল এবং সঙ্গে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি নিয়েও তা করতে পারছেনা কেন?

প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে আমি প্রথমেই তার সঙ্গে একমত হই। তারপর তার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর খুজার চেষ্টা করি। কেন না ভারত যা করতে পেরেছে বা পারছে তা আমরা পারছি না। কেন পারছি না তা দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। কারণ, আমাদের গোটা পর্যটন শিল্প নিয়েই আমরা এখনো পেছনের কাতারের দেশগুলোর একটি। পর্যাপ্ত পর্যটন সম্পদ এবং মানব সম্পদ থাকার পরও আমরা ব্যর্থতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। সদিচ্ছা, প্রশাসনিক কাঠামো, পরিকল্পনা, সার্বিক ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন, আইন, পণ্য ও সেবার মান, গবেষণা, পরিসংখ্যান ও তথ্য ভাণ্ডার ইত্যাদি নানা ঘাটতি ছাড়াও দুর্বল কমিউনিকেশন এন্ড কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ ও সংযোগ অবকাঠামো পর্যটন উন্নয়নের পথে আরেকটি প্রধান অন্তরায়।

এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যেই আমাদের পর্যটনের জন্য যোগাযোগ ও সংযোগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে সম্ভাবনার বারতা নিয়ে এসেছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যাকে অবলম্বন করে শুধু আলোচ্য সুন্দরবনই নয় কুয়াকাটা এবং বাগেরহাটের আরেক বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য পর্যটক আকর্ষণগুলোও যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে পর্যটন উন্নয়নের ঘাটতি অনেকটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে, তাও কিন্তু একেবারে সহজ বা কথার কথা নয়। কেন না এই সুবর্ণ সুযোগও হাতছাড়া হওয়ার মতো ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে যদি না সঠিক সময়ে সঠিক কাজগুলো করা না যায়।       

এটা আমরা সবাই জানি এই সময়ে পদ্মা সেতু নিয়ে গোটা জাতির মধ্যে যে ক্রেজ বা উন্মত্ততা সৃষ্টি হয়েছে তাতে দলে দলে, ঝাকে ঝাকে মানুষ ছুটবে পদ্মা সেতুতে এবং সেতু পাড়ি দিয়ে ওই পারে। আর তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে বৃষ্টি বাদল আর বন্যার সমাপ্তি শেষে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কারণ শুধু সহজে ও অল্প সময়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার সুযোগই নয় ইতোমধ্যে আমাদের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা কোটির ঘর ছাড়িয়ে গেছে। মানুষ এখন নানা কারণে শুধু যে ঘর থেকে বেরুনো এবং বেড়ানো শিখে গেছে তা নয় অভ্যস্তও হয়ে যাচ্ছে। এতে করে পদ্মার ওই পারে ছুটে চলা মানব স্রোত শুধু সুন্দরবন আর কুয়াকাটাই নয় দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য সবগুলো পর্যটক আকর্ষণে বা গন্তব্যে ক্রমান্বয়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।                             

আবার এই চাপেরও কিন্তু ভালো মন্দ উভয় দিক রয়েছে। ভালো দিকটা হচ্ছে, পর্যটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিকেশন এন্ড কানেক্টিভিটি বা যোগাযোগ ও সংযোগ সমস্যা অনেকটাই দূর হওয়ার ফলে ‘টেনে নেওয়া এবং ঠেলে দেওয়া’ তত্ত্ব কার্যকর হবে। সমাজবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘পুল এন্ড পুশ’ থিওরি বলে থাকেন। সহজ কথায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভ্রমণার্থীদের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে ঠেলে দেবে এবং দক্ষিণাঞ্চল স্বাভাবিকভাবে তাদের টেনে নেবে। এমনকি মনোস্তাত্বিকভাবে ক্রেজের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষরাও এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় বেড়ানোর জন্য উৎসাহ বোধ করবে এবং ঘর থেকে বেরিয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে যে আগে বেড়াতো না সেও বেড়ানোর উৎসাহ পাবে। এতে ট্যুরিস্ট ফ্লো বা পর্যটক প্রবাহ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। যা কিনা পর্যটনের জন্য যারপরনাই সুখবর। কেন না সাময়িক হলেও এই অঞ্চলের সেবাখাত নির্ভর অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, স্থানীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে, দেশি-বিদেশি পর্যটন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে, কর্মবিমুখতা কমে কর্মচাঞ্চল্য অনেকাংশে বেড়ে যাবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব দূর হবে, সাংস্কৃতিক লেনদেন বাড়বে, মানুষে মানুষে সরাসরি যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বোপরি পরিবেশ রক্ষার ও টেকসই উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে।  

অপরদিকে মন্দ দিকটা হচ্ছে, হঠাৎ ট্যুরিস্ট ফ্লো বা পর্যটক প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দুর্বল পর্যটন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়তে পারে; ধারণ ক্ষমতার বেশি পর্যটক আগমনের ফলে পর্যটন বিনাশী মাস ট্যুরিজম বা গণপর্যটনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে; মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে অতিরিক্ত যান চলাচল থেকে সৃষ্ট জট যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে; পর্যটক সেবা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত চাপে পড়ে সেবার মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে; পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে; জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়বে; প্রত্নসম্পদ বিনষ্ট হবে, ছোট ও মাঝারি অপরাধ বৃদ্ধি পাবে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে পর্যটন বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমতাবস্থায় এসব ভালো-মন্দের ভারসাম্য রক্ষা করে পর্যটন উন্নয়নের এই অবারিল ও সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য যা যা করা দরকার তা যথা সময়ে না করলে সব সম্ভাবনাই শেষ পর্যন্ত হাওয়ায় ভেসে যেতে পারে। এজন্য প্রথমেই পদ্মা সেতু উদ্ভুত পর্যটন সম্ভাবনাকে দুটো ভাগে ফেলতে হবে। প্রথম ভাগে থাকবে শুধু ‘পদ্মা সেতু পরিদর্শন’ তথা সেতু কেন্দ্রীক জনসমাগম এবং দ্বিতীয় ভাগে থাকবে ‘দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণ’ তথা পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্যমুখী জনসমাগম। প্রথম ভাগে যারা শুধু পদ্মা সেতু দেখতে যাবে তাদেরকে আপাতত বলা যাবে ‘ডে ট্রিপার/সেম ডে ভিজিটর’ বা একই দিনের পরিদর্শক। তবে তাদেরকে ট্যুরিস্ট বা পর্যটক বলা যাবে না। কারণ, ট্যুরিস্ট বা পর্যটক হতে হলে অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা বা একরাত যাপন করতে হয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগে যারা পদ্মা সেতু অতিক্রম করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্যে যাবেন এবং কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা বা একরাত যাপন করবেন তারা মূলত ট্যুরিস্ট বা পর্যটক বলেই বিবেচিত হবেন। অবশ্য তার সঙ্গে স্থানীয়ভাবে ডে ট্রিপার/সেম ডে ভিজিটর বা একই দিনের পরিদর্শকও থাকবেন।

এজন্য আমরা এই দুটি ভাগকে আলাদাভাবে বিবেচনায় রাখব। যেখানে পদ্মা সেতু থেকে প্রাপ্ত কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনের জন্য কিভাবে সর্বোত্তম ফায়দা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখব। তবে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ব্যবস্থাপনা ও রক্ষাণাবেক্ষণের দিক থেকে আমরা সব সময়ই অত্যন্ত দুর্বল। যেজন্য রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, পরিবার, ব্যক্তি সকল ক্ষেত্রেই আমরা এই বিষয়গুলোতে ব্যর্থ হই। ফলশ্রুতিতে অনেক সম্ভাবনা ও সুযোগ এবং কর্মতৎপরতা ও উদ্যোগ এক পর্যায়ে হ্য় ধারাবাহিকতা হারায় না হয় উদ্দেশ্য সাধনে ব্যাঘাত ঘটায়। যেমনটি বত্রিশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে যে পদ্মা সেতু তৈরি করা হলো তার ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাত্র পাঁচ শতাংশ অর্থ আগে থেকেই খরচ করে আগাম ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করার ফলে এখন পদে পদে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমনকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখন আমরা একটার পর একটা সমস্যায় পড়ছি আর ঠেকে শেখার মতো শিখছি, ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই আমরা প্রথমে পদ্মা সেতু কেন্দ্রীক ডে ট্রিপার/ডে ভিজিটার বা যাদেরকে আমরা একই দিনের পরিদর্শক বলে থাকি তাদের জন্য কি কি করা যেতে পারে তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করব। অবশ্য এর মধ্যে স্বল্প ও দীর্ঘ উভয় মেয়াদের করণীয় বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যেমন-  

এক. পদ্মা সেতুর উভয় প্রান্তে ভিজিটর সেন্টার বা পরিদর্শক কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। যেখানে থাকবে মানসম্পন্ন বিশ্রামাগার, শৌচাগার, পার্কিং এরিয়া, রেস্তোরাঁ, বিজনেস সেন্টার, শপিং আর্কেড, সেমিনার/সভা কক্ষ, বুক স্টল, ভিজুয়াল লাইব্রেরি, ইনফরমেশন এন্ড কম্পলেইন সেন্টার ইত্যাদি।

দুই. সেতু পরিদর্শনের জন্য জল, স্থল ও আকাশ সুবিধা সবই ব্যবহার করা যাবে। জল পথে আধুনিক ক্যাটামারান, ওয়াটার বাস, স্পিড বোট ইত্যাদি; স্থল পথে মান সম্পন্ন লাইট এন্ড ওপেন ট্যুরিস্ট ভেহিকেল বা হালকা ও খোলা পর্যটক যান এবং আকাশ পথের জন্য হেলিকপ্টার রাইড সুবিধা থাকবে।

তিন. পরিদর্শক চাহিদা ও সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে দুই, চার, ছয় ও আট ঘণ্টার এবং বিভিন্ন মানের প্যাকেজ থাকবে। এসব প্যাকেজের বিভিন্ন নাম থাকবে এবং প্যাকেজ সম্মন্ধে বিস্তারিত জানা ও অগ্রিম ক্রয় করার জন্য তথ্য সমৃদ্ধ এপসের পাশাপাশি ওয়েব সাইট থাকবে। অন্তর্ভুক্ত থাকবে পদ্মা সেতুর ইতিহাসভিত্তিক ভিডিও প্রদর্শনী, যাদুঘর পরিদর্শন, ছবি তোলার সুবিধা এবং হালকা স্ন্যাকস ও পদ্মার ঈলিশ নিয়ে বিশেষ বিশেষ ডিস।

চার. সেতু পরিদর্শনের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সরাসরি কিছু প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত রেখে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে চাহিদা মোতাবেক পরিদর্শকদের অংশগ্রহণভিত্তিক আকর্ষণীয় ভিডিও ক্লিপ বা শর্ট ফিল্ম সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

পাঁচ. মনে রাখতে হবে সেতু পরিদর্শনের এই যে ক্রেজ বা উন্মত্ততা তা এক সময় নাও থাকতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে, যদিও পদ্মা সেতুর ব্যাপারটি কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমী। তাই দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সেতুর উভয় প্রান্তে সরকারি-বেসরকারি অথবা উভয় খাতের যৌথ উদ্যোগে ও বিনিয়োগে মান সম্পন্ন রিসোর্ট, কনফারেন্স সেন্টার, এমিউজমেন্ট সেন্টার, থিম পার্ক ইত্যাদি গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে উদ্যোগ এবং শিল্প সহায়ক পরিবেশ ও সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। তবে পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষার বিষয় মাথায় রেখে কোনো অবস্থাতেই অপরিকল্পিত এবং ব্যাঙের ছাতার মতো যেকোনো ধরনের স্থাপনা বা ব্যবসা গড়ে উঠাকে শুধু নিরুৎসাহিতই নয় প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করতে হবে। এজন্য অনুমতি ও অনুমোদন প্রাপ্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় ভাগে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে যেসব দেশি-বিদেশি পর্যটক দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্যে যাবেন তাদের এই ফ্লো বা প্রবাহকে ধরে রাখা এবং স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য নিতে হবে নানামুখি উদ্যোগ। এসব উদ্যোগ স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে নিশ্চিত করে তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করার জন্য যা যা করতে হবে তা হলো -    

১. স্থানীয়ভাবে পর্যটন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দায়িত্বশীল পর্যটনের আদলে স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, পর্যটন ব্যবসায়ী, পর্যটক, গণমাধ্যম, মহিলা এবং এন জি ও প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে এই সাত অংশিদারের প্রত্যেকের দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করার মাধ্যমে কাজ শুরু করতে হবে।

২, সার্বিক এবং সার্বক্ষণিক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার প্রয়োজনেই আঞ্চলিক পর্যটন অফিসের কার্যক্রম চালু করতে হবে।

৩. সার্বিক নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থানীয় পুলিশ এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের সমন্বয়ে সেফটি নেট বা নিরাপত্তা জাল ও কানেক্টিভিটি বা সংযোগ গড়ে তুলতে হবে। যাতে পর্যটক, পর্যটন কর্মী, সেবা প্রতিষ্ঠান, পর্যটক আকর্ষণ, পর্যটন স্থাপনা, প্রত্ন সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, রাস্তা-ঘাট, পর্যটন যান ইত্যাদির সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক থাকে।

৪. প্রয়োজনে স্কাউট, গার্লস গাইড এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখতে হবে যাতে যেকোনো প্রয়োজনে এদের কাজে লাগানো যায়।

৫. অধিক পর্যটক সমাগম হয় এমন গন্তব্যগুলোতে পর্যটকদের নাইট লাইফ বা নৈশকালীন বিনোদন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে স্থানীয় শিল্পীদের অংশগ্রহণে ওপেন এয়ার বা মুক্তমঞ্চ ভিত্তিক কালচারাল শো, ভেরাইটি শো ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখতে হবে।

৬. সার্বিক ও সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে পর্যাপ্ত সিসি টিভি ছাড়াও ওয়াচার ও ডাটা কালেক্টর নিযুক্ত করতে হবে।

৭. পর্যটক তথা পর্যটন সেবা ছাড়াও পর্যটক আকর্ষণ বা স্থান সম্পর্কে আগাম এবং সর্বশেষ ও সঠিক তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রের পাশাপাশি বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করতে হবে।

৮. দেশে-বিদেশে দক্ষিণাঞ্চলের একুশ জেলার পর্যটক আকর্ষণ ও গন্তব্যগুলোর প্রকৃত পরিচিতি তুলে ধরা এবং পর্যটন পণ্য বিপণনের সুবিধার্থে প্রোডাক্ট এন্ড ডেস্টিনেশন ব্রান্ডিং বা পণ্য ও গন্তব্য সংকেতীকরণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

৯. আচরণবিধি, স্বাস্থ্যবিধি, সেবার মান ও মূল্য, পরিবেশের ভারসাম্য, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো নজরদারীর মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্যে শক্তিশালী ভিজিলেন্স টিম কাজে লাগাতে হবে।

১০. পর্যটনের বৃহতর স্বার্থে গণপর্যটন, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি ধ্বংস, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, নিরাপত্তা হুমকি ইত্যাদি মোকাবেলার মতো বিষয়গুলো মাথায় রেখে পিকনিক পার্টি ও ডে ট্রিপার/সেম ডে ভিজিটর ইত্যাদি যারা পর্যটক নন তবে একই দিনের পরিদর্শক তাদের উপস্থিতিকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে কঠিন আচরণ বিধি প্রয়োগ এবং প্রবেশ ফি নির্ধারণের মেতা বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

১১. স্থানীয়ভাবে পর্যটন যান, আবাসন, খাবার ও পানীয়, বিনোদন, ট্র্যাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর, ট্যুর অর্গানাইজার প্রতিষ্ঠান এবং ট্যুরিস্ট গাইড ইত্যাদি যারা সরাসরি পর্যটন সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও নিবন্ধিত তাদের তালিকা প্রণয়ন করে নেটওয়ার্কিং করতে হবে। এতে একদিকে কানেক্টিভিটি বা সংযোগ তৈরি হবে এবং অন্যদিকে তাদের কার্যক্রম নজরদারির পাশাপাশি তালিকা বহির্ভূত কেহ বা কোনো গোষ্ঠী গজিয়ে উঠার সম্ভাবনা কমে যাবে।

১২. পর্যটন সেবা সম্পৃক্ত সব ধরনের কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, প্রশাসনিক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন এমনকি স্থানীয়ভাবে দায়িত্বশীল পর্যটনের আদলে গঠিত কমিটির সদস্যসহ পর্যটন সম্পৃক্ত সকলের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ছোট ছোট মডিউল ব্যবহার করে পর্যটনের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৩. বিদ্যমান সকল ধরনের পর্যটন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার ধরণ, মান, ও ঘাটতি চিহ্নিত করার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস’ বা কিউ টি এস পদ্ধতি চালু করতে হবে। পাশাপাশি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরাজিত সমস্যা চিহ্নিত করে তা নিরসনে সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগীতা নিশ্চিত করতে হবে।

১৪. পর্যটন অবকাঠামো তথা পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত সব ধরনের সেবা খাতে দেশি-বিদেশি এবং যৌথ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিল্প সহায়ক সুবিধা যেমন ভূমি, স্বল্প সুদে ঋণ, কর রেয়াত, উপকরণ আমদানিতে কর ছাড়, প্রণোদনা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাসন, বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনকল্পে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে।

১৫. দীর্ঘ সময় ও বড় ব্যয়ে যে ট্যুরিজম মাষ্টার প্ল্যান বা পর্যটন মহাপরিকল্পনা হতে যাচ্ছে তাতে গোটা দেশের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন সম্পদ চিহ্নিতকরণ, পণ্য উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও বিপণনের মতো বিষয়গুলো যাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে স্থান পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

১৬. যে কোনো অবস্থাতেই পরিকল্পিত পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতাকে অবজ্ঞা কিংবা পরিবর্তনের মতো গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

অবশ্য এসব পদক্ষেপ গ্রহণ এক কথায় যথেষ্ট তা বলা যাবে না। কেন না সার্বিক পর্যটন উন্নয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে আরো অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে। তবে, পদ্মা সেতু থেকে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগানো এবং দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়া ও ধরে রাখার জন্য এসব করণীয় অনেকটাই যে যথেষ্ট তাও আবার অস্বীকার করা যাবে না। অতএব, এই পরামর্শগুলোর আলোকে সরকারি এবং বেসরকারি খাতের সকল ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডার বা পর্যটন দায়কগোষ্ঠী তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে আসা আশার আলোকে প্রজ্বলিত করতে পারলে সার্বিক পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অবশ্যই একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। তার সঙ্গে আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটন সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিয়ে ওই তিশা সেন’র মতো কারো সরাসরি প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে না হলেও অনেকটা কমে যাবে।     

লেখক : চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ, সিটিএস।

পর্যটনের ধারণা বদলে দিচ্ছে উটির চা-চকলেট, শ্রীমঙ্গল কেন পিছিয়ে
অজস্র কল্পকথার কামরূপ কামাখ্যা দর্শন

আপনার মতামত লিখুন