শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ১২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ইভেন্ট

টাঙ্গুয়ার নীরব হাহাকার

জাহিদুর রহমান
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

টাঙ্গুয়ার হাওর- বিশাল এই জলাভূমিতে প্রকৃতি বেড়ে উঠেছে আপন খেয়ালে। সুনামগঞ্জে ৫১টি জলমহালের সমন্বয়ে ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টরের টাঙ্গুয়ার হাওরের মানুষ মাছ ও ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল। কথা হচ্ছিল তাহিরপুরের বাসিন্দা রণজিৎ চন্দ্র দাসের সঙ্গে। গত ৩০ বছর ধরে তিনি টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, 'বড় বড় মাছ মিলত এক সময়। কিন্তু গত ৮-১০ বছর ধরে সে মাছ হারিয়ে গেছে। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল পেতে বসে থাকলেও ছোট দু'চারটি পুঁটি ছাড়া তেমন কিছু মেলে না। বিক্রি তো দূরের কথা, ছেলেমেয়ের পাতেই মাছ দিতে পারি না।'

এককালের মাছ ও জীবৈচিত্র্যে ভরপুর হিসেবে খ্যাত দেশের বড় এ জলাভূমি থেকে কেন মাছ হারিয়ে গেছে, তা জানতে কথা হয় হাওরবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তার বলছেন, শুধু মাছই নয়, আগের মতো পাখ-পাখালি কিংবা অন্য জীবজন্তুও কমে গেছে। কমছে সবুজও। হারিয়ে গেছে অনেক বিল। দূষণ, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, পাখি শিকার, বৃক্ষ উজাড়, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও ঠিকমতো সংরক্ষণের অভাবে ইতিহাসের পাতায় চলে যাচ্ছে মাছসহ অন্যান্য প্রজাতি। ফলে হাওরের মানুষকে এখন পুকুরে চাষ করা পাঙাশ, তেলাপিয়া ও কার্প জাতীয় মাছের ওপর নির্ভর করতে হয়।

টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রাণ-প্রকৃতি কমে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে গত মাসে পরিচালিত বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের যৌথ জরিপেও। দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এবার টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির বিচরণ কমেছে প্রায় ৩২ হাজার। এবার ২৭ হাজার ১৭০টি পাখি গণনা করা হয়। এর আগে ২০২১ সালে পাখির সংখ্যা ছিল ৫৯ হাজার ৭৪টি। ২০২০ সালে ৫১ হাজার ৩৬৮টি, ২০১৯ সালে এক লাখ ৪৬ হাজার ৩০টি, ২০১৮ সালে ৫৯ হাজার ৫৪২টি, ২০১৭ সালে ৯১ হাজার ২৩৬টি, ২০১৬ সালে ৪২ হাজার ৫৫৮টি এবং ২০১৫ সালে ৫২ হাজার ২৯৯টি পাখি গণনা করা হয়।

পাখির সংখ্যা কমার বিষয়ে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনাম আল হক সমকালকে বলেন, আমরা যেমন অনুকূল পরিবেশ দেখে বাসস্থান নির্বাচন করি; পাখিও তার বাসযোগ্য অঞ্চল বেছে নেয়। সেখানে সমস্যা হলে তারা উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র চলে যায়।

টাঙ্গুয়ার হাওরের মাছের উৎপাদন নিয়ে আলাদা কোনো তথ্য সরকারি কোনো দপ্তরে পাওয়া যায়নি। তবে তাহিরপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সারোয়ার হোসেন জানান, এখানে ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।

হাওরের বুকজুড়ে ছিল সারি সারি হিজল-করচ গাছ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনক হারে তা কমেছে। তাহিরপুরের শ্রীপুরের বাসিন্দা আব্দুল হক বলেন, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার এবং মাছ চাষের সময় পানিতে দেওয়ার জন্য হিজল-করচ গাছ কাটা হচ্ছে।

এ ছাড়া একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের চাপ এবং বেশিরভাগ পর্যটকের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি উদাসীনতার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে

সংরক্ষিত এ জলাভূমি। প্লাস্টিক দূষণ, রাতে লাইট জ্বালিয়ে নৌকায় অবস্থান, উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোসহ নানা কারণে হুমকির মুখে টাঙ্গুয়া। স্থানীয়দের তথ্যানুসারে, বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ইঞ্জিনচালিত নৌকা হাওরে প্রবেশ করে।

পর্যটক ছাড়াও হাওরের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল। ঢলের সঙ্গে পাহাড় থেকে আসা বালু-পাথর-কয়লা ও চুনাপাথরে ভরাট হতে শুরু করেছে হাওর।

১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে এই হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রামসার কনভেনশনের আওতায় দেশের 'রামসার সাইট' হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত হয়। ২০১৭ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং আইইউসিএনের যৌথ প্রকল্প শেষ হওয়ার পর থেকে হাওরের দায়িত্বে আছে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন। শুরুর দিকে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২২ কোটি টাকা) অনুদানে বাস্তবায়িত একটি প্রকল্প চলার সময়ই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রথম প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের করা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পে ৭৪টি গ্রামে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে বলে দাবি করলেও বাস্তবে এর অধিকাংশ কমিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রকল্পকালে হাওরে ১ লাখ ৫৭ হাজার হিজল-করচ গাছ লাগানোর কথা জানালেও বাস্তবে এসব গাছের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার তেমন গবেষণা নেই। গবেষণার ওপর জোর দিয়ে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিকল্প কর্মসংস্থান ও বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। ফসল রক্ষার নামে যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না। এই হাওরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা জরুরি। মাছের উৎপাদন বাড়াতে হাওরে প্রজনন মৌসুমে দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এ সময় জেলেদের প্রণোদনা দিতে হবে। একই সঙ্গে কারেন্ট জাল ও প্লাস্টিকের ছাই দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, হাওরকে রক্ষা করতে হলে এর ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রথাগত আমলাতান্ত্রিক সমাধানের বাইরে গিয়ে হাওরকে বোঝেন বা হাওরের প্রতি আন্তরিকতা আছে এমন লোকজনকে সম্পৃক্ত করা দরকার। প্রয়োজনে টাঙ্গুয়ার হাওর কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগামী মৌসুম থেকে হাওরের সংরক্ষিত এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পর্যটকরা নির্দিষ্ট একটি অংশে ইঞ্জিন নৌকায় থাকবেন আর হাওরের অভ্যন্তরে ভ্রমণের জন্য লগি-বৈঠার সাধারণ নৌকা ব্যবহার করতে পারবেন। এতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানও বাড়বে। এ ছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষায় বিকল্প কর্মসংস্থান ও পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।

আজ বিশ্ব জলাভূমি দিবস :বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি আইইউসিএন, ইউনেস্কোসহ পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হচ্ছে। এসব কর্মসূচি পালনের মূল লক্ষ্য পরিবেশ রক্ষায় জলাভূমি সংরক্ষণ।

মহানবীর মদিনায় যাওয়ার পথ ধরে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা
নানা অজুহাতে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না পর্যটকরা

আপনার মতামত লিখুন