শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

আহমদ ছফা এক অজর বিশেষ্য আর অবিনাশী বিশেষণ

মিজান বিন মজিদ
৩০ জুন ২০২০

বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিকে 'আঁতলামি' হিসেবে গালি দেয়া হয়। নিবিষ্ট পাঠকের শুনতে হয়,কটুকাটব্য। প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করলে জনে জনে হাসাহাসির রোল ওঠে। গ্রামের কেউ নগরের নাগরকে টপকাতে গেলে 'গোল' বাঁধে। একরোখা স্বভাবের, বিচিত চিন্তার,আর উদ্ভাবনী মননের হলে বিপত্তি বেশুমার। উপর্যুক্ত সকল বিশিষ্টতা নিয়ে চট্টলার চন্দনাইশ থেকে ঢাকা এসেছিলেন জনৈক আহমদ ছফা। তাঁর আজ জন্মদিন...। লেখালেখি দেখি যৎসামান্য,এধার ওধার। কেন  তাঁর শরণ ও স্মরণ আবশ্যক? 

বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব প্রত্যাখানের সৎসাহস রাখেন এইজন্য? জেনারেল জিয়ার সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন সেই সূত্রে? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বহস্থে প্রস্তুত ব্যঞ্জনে আপ্যায়িত করেছেন বলে? বেগম জিয়ার (প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন)পিএসকে আচ্ছামতন ধোলাই দেয়ার বিরল ক্ষমতা দেখিয়েছেন জন্য! একজন আহমদ ছফাকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা গল্প লতিয়ে ওঠা কাহিনি আপাত দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য হলেও তার সবই সত্য না হলেও অসত্য অতি সামান্যই। বলা চলে ওগুলো সাহিত্যিক বর্ণনার অতিশায়নমাত্র। তিনি কেন স্মর্তব্য হবেন,যুবকরা কেন তাঁকে খুঁজবে-বুঝবে এই প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। 

ছফার লেখালেখি বিস্তর নয়। কিন্তু মৌলিকতার প্রশ্নে শেকড়সন্ধানী ও চিন্তা উদ্রেককারী। বিশেষত প্রবন্ধে  নিজস্ব শৈলি প্রতিষ্ঠা  করতে সক্ষম হয়েছেন। উপন্যাসের মধ্যেও পূর্বতন ধারার সঙ্গে আপন গতিপথকে নবাঙ্গিক দেবার প্রচেষ্টা ছিলো লক্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের হতশ্রী চেহারার অতুল চিত্র এঁকেছেন সেইকালে 'গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসে। প্রেমের নিপুণ নিকাশ করেছেন 'অর্ধেক মানবী,অর্ধেক ঈশ্বরী'গ্রন্থে। আমি এইসব প্রথাগত মূল্যায়নকে গুরুত্ব না দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে চাই।

আহমদ ছফা ছিলেন তাঁর সমকালের শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও অবিনশ্বর দেশপ্রেমিক। অচিন ঢাকায়,অভিভাবকশুন্য তারুণ্যের ঠিকানা ছিলো আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস,আজিজ সুপার মার্কেট।যেখানে একজন ছফা   থাকতেন। অর্থশুন্য খ্যাতিপ্রত্যাশী আর বিপুল সম্ভাবনাময়ী অজস্র যুবকের জন্যে তিনি হয়ে উঠতেন পরম আশ্রয়। সেকালের কঠিন কঠোর অনাত্মীয় ঢাকায় তার স্নেহের স্পর্শে কতজন যে লেখক শিল্পি হয়ে উঠেছে তার হিসাব করা গবেষণার বিষয়। আজকের বহু বিখ্যাত লেখকের প্রথম প্রকাশ,দারুণ বিকাশ, প্রভূত নামযশের পেছনে ছফাখ্যান জড়িত। আমার কাছে এই অতুল বিরল অভিনব ব্যক্তিত্বের ছফাকে মনে হয়েছে তাঁর টোটাল চরিত্রের শীর্ষবিন্দু। 

দেশপ্রেমের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনাপোস,রুদ্রমূর্তির আর দারুণ বিপ্লবী। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে কলকাতার গ্রন্থবেনিয়াদের একক কর্তৃত্ব খর্ব করবার কাজটি তিনি করেছিলেন কিংবদন্তিতুল্য দুঃসাহসে। ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিমের পণ্ডিতদের নৈরাজ্য স্বরাট ভরাট কণ্ঠে। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' দিয়ে খুলে দিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীতার নামে দলদাসী মনোবৃত্তির 'চালাক' পণ্ডিতদের সারস্বত ভানের মুখোশ। যারা এইদেশের কলা খেয়ে ওই দেশের মূলা ঝুলাতে চান, ডিসকোর্সের ভেলকিতে; তাদের উদোম করে ছেড়েছেন রাস্তায়! আমাদের মাথার উপরে যারা বসে আছেন 'মহামনীষী'তকমায় তারা কতটা নীচ ও আত্মস্বার্থপর তার বিত্তান্ত খোলাসা করেই ক্ষান্ত হন নি,রুখে দিয়েছেন তাদের বহু স্বপ্নবিলাস। এইজন্য তারা কম দৌড়ান নি ছফাকে...। সব প্রকার পুরস্কার বঞ্চিত হয়েও লড়েছেন আমাদের স্বকীয়তা স্বাধীকার ও সার্বভৌম সত্তা বিনির্মাণের জন্য। এমন ন্যায়বান তেজী নির্লোভ ও স্বাধীনচেতা মানুষ আপনি কল্পনা করতে পারবেন,বাস্তব দর্শন অসম্ভব। তিনি ধর্ম নিয়ে কী ভেবেছেন,এই গুরুতর প্রশ্নটিও কেউ কেউ তুলে আনছেন। একটা বাক্য বলি, তাঁর ভেতরের 'আল্লাহ' আমার-আপনার মতন ঠুনকো বুদ্ধির মানুষের চর্মচক্ষে দৃশ্যমান নাও হতে পারে...। প্রতি শুক্রবার নিরুদ্দিষ্ট ছফাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান একজন তাঁকে পেয়েছিলেন,তৎকালের বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্বের একান্ত সান্নিধ্যে...।

আমরা যদি আর দুচারজন আহমদ ছফা পেতাম,এই দুঃখ জর্জর বাংলাদেশের চেহারা ভিন্ন হতে পারতো। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এইসব তরলায়িত শব্দবন্ধকে তার জন্যে ব্যবহার না করে বলি, তিনি সবকালের বাঙালি যুবার পরম প্রতিপাদ্য ব্যক্তিত্ব হওয়া উচিত। উচিত এইজন্য যে,এই দেশ ও এই দেশের মানুষের প্রতি তাঁর টান ছিলো  যে কোন মানুষের চেয়ে নিখাদ নির্মোহ ও নিঃস্বার্থ। জন্মদিনের এই মহালগ্নে তাঁকে স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধায় আর অপার ভক্তিতে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ

করোনাকালে দেশের জন্য বড় সুখবর: জার্মানিতে ওয়ালটন টিভি রপ্তানি জোরদার
উদয় হাকিমের উপস্থাপনায় লাইভ শো ‘ত্রিবেণী’

আপনার মতামত লিখুন