শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

নিঝুম দ্বীপ ঘিরে নোয়াখালীর পর্যটন শিল্পের যে সম্ভাবনা

সোহেল মো. নাফি
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২

পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশে। পর্যটক আকর্ষণের সকল উপাদান বিদ্যমান রয়েছে এখানে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এদেশের সৌন্দর্যে ভ্রমণ পিপাসুরা মুগ্ধ হয়েছেন যুগে যুগে। বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও পর্যটক আকর্ষণে যে বৈচিত্র্যময় সম্পদ এই দেশে রয়েছে তা সহজেই যে কোনো মানুষকে আকর্ষণ করতে সক্ষম। এদেশে রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র সম্পদ যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই।

বিশ্বের দীর্ঘতম ও নিরবচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের জন্য বিখ্যাত স্থান সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতি ও সবুজ বনভ‚মি ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, পাহাড়ের বুকে সবুজের গালিচা বিছানো সিলেটের চা বাগান, গৌরবোজ্জল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতœতাত্তিক নিদর্শনগুলো বাংলাদেশকে করেছে অনন্য। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে পর্যটনের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম।

বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি শিল্প হিসেবে পরিচিত পর্যটন শিল্প। একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ভ‚মিকা অপরিহার্য। জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ২০১৯ সালে বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ এবং আর্থিক সেবাখাতের পরেই ছিল পর্যটন শিল্প। তবে করোনা মহামারীর কারণে সারা পৃথিবীর সকল অর্থনৈতিক কর্মকাÐ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় পর্যটন শিল্প। ২০১৯ সালে বিশ্ব জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ যা ২০২০ সালে এসে ৫.৫ শতাংশে নেমে আসে। একইভাবে এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান, বিনিয়োগসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতি হয়। তবে ২০২১ সালে মাঝামাঝি থেকে করোনার প্রভাব কিছুটা কমতে থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সীমিত পরিসরে পর্যটন স্থানগুলো খুলে দিয়েছে। এতে করে পর্যটন স্থানগুলো আবারো মুখর হয়ে উঠেছে পর্যটকে। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা বলছে, করোনা ভাইরাসের ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে প্রায় দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনাকালীন ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য এরই মধ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পর্যটন ব্যবস্থা বর্তমানে সকল দেশে প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের ভ‚মিকা অপরিসীম। বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পর্যটক ঘুরে বেড়ান তার সিংহভাগই দেশীয় পর্যটক।

বিগত এক দশকে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এই সময়ে এক দিকে যেমন নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে পর্যটকের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুণ। সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, পর্যটকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, পর্যটন স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কারণে দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। শুধুমাত্র কক্সবাজারের পর্যটনকে ঘিরে বর্তমান সরকারের রয়েছে মহাপরিকল্পনা। কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার এবং তার কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিবছরে এতে বাড়তি ২ শত কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এই সকল স্থানে প্রায় ৪০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পর্যটক আকর্ষণে নির্মাণ করা হয়েছে মেরিন ড্রাইভ রোড। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে একটি প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে, ঢাকা থেকে কক্সবাজার নির্মাণ করা হচ্ছে রেললাইন। কক্সবাজারের পাশাপাশি দেশের অন্যান পর্যটন স্থান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। যা সেইসব অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রসিদ্ধ ও প্রাচীন জেলা নোয়াখালী। ঢাকা থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। এই জেলায় পর্যটন বিকাশে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। নোয়াখালী জেলায় রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থাপনা। শুধুমাত্র নিঝুম দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে নোয়াখালী জেলার পর্যটন শিল্প যা এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতীক হতে পারে। নোয়াখালী জেলার পর্যটন সম্পদের মধ্যে নিঝুম দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, বজরা শাহী মসজিদ, গান্ধি আশ্রম, জগন্নাথ মন্দির, শ্রী রাম ঠাকুরের মেলা, কমলা রাণীর দীঘি, কল্যান্দী সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, ফকির ছাড়– মিজি (রহ.) সাহেবের দরগাহ, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর, মুছাপুর ক্লোজার, স্বর্ণ দ্বীপসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

৪০ বর্গমাইল আয়তনাবশিষ্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভ‚মি নিঝুম দ্বীপ। নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়া উপজেলার সর্বদক্ষিণে নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের বুকে ১৯৪০ সাল থেকে এই দ্বীপটি জেগে উঠা শুরু করে। ১৯৭৩ সালে এই দ্বীপটিতে জনবসতি শুরু হয়েছিল। কেওড়া গাছপালা পরিবেষ্টিত এ দ্বীপটিতে ১৯৭৮ সালের দিকে প্রাণিবৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য চার জোড়া চিত্রা হরিণ উন্মুক্ত করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই চিত্রাহরিণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজারে। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে অপূর্ব সবুজের সমারোহ, বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, নদী, বিভিন্ন প্রকার পশুপাখিসহ বিচিত্র ধরণের জীব বৈচিত্র্য।

অর্থাৎ নিঝুম দ্বীপে কক্সবাজারের মত সমুদ্র সৈকত ও সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মত সৌন্দর্য একই সাথে উপভোগ করা যায়। পাশাপাশি বিস্তীর্ণ সৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য। একইসাথে প্রকৃতির অনেক রূপ ও বৈচিত্র্য এসে ধরা দিয়েছে এই নিঝুম দ্বীপে।

অপার সম্ভাবনা থাকার পরও নিঝুম দ্বীপে পর্যটনের কোন বিকাশ হয়নি বলা যায়। মাত্র হাতেগোনা কিছু পর্যটক এই দ্বীপ তথা নোয়াখালী জেলা ভ্রমণে আসে। এর প্রধান কারণ হল নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের জন্য কোন সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা, মানসম্মত হোটেল বা রিসোর্টের অপ্রতুলতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবে এই দ্বীপ এখনো পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে নি। রাজধানী ঢাকা থেকে নোয়াখালী বা নিঝুম দ্বীপে যাতায়াত করার জন্য বাস, ট্রেন ও লঞ্চ ব্যবহার করা যায়। তবে এসবের কোনটিই পর্যটক আকর্ষণের জন্য মানসম্মত নয়। তাছাড়া হাতিয়ার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও পর্যটকদের জন্য সহায়ক নয়। নিঝুম দ্বীপ তথা নোয়াখালী জেলার সার্বিক পর্যটন বিকাশে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে। পর্যটন সম্পর্কে জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে তুলে ধরতে হবে। পর্যটকদের স্বাভাবিক যোগাযোগ সুবিধা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে করে পর্যটকের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও উপকৃত হবে।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন উদ্যেগে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় যা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এই অঞ্চলের পর্যটন উন্নয়নে সর্বপ্রথম যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এইক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত আধুনিক বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া নিঝুম দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য পরিবেশ বান্ধব রিসোর্ট তৈরী করতে হবে। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে ‘কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম’ বা ‘হোম স্টে’ শুরু করা যেতে পারে। এই সকল বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করার জন্য পর্যটন বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতে পারে।

নোয়াখালীর পর্যটনের উন্নয়নের জন্য সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলা ব্রান্ডিং এর আওতায় নোয়াখালীকে ‘নিঝুম দ্বীপের দেশ’ নামে ব্রান্ডিং করার কাজ চলছে। নিঝুম দ্বীপের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে এসব উন্নয়ন কর্মকাÐ পরিচালনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে হবে পরিকল্পিতভাবে। অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কর্মকাÐ সংগঠিত হলে তা পরিবেশ, স্থানীয় জনগণ ও পর্যটনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হবে। এতে করে নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে। এই জন্য পর্যটনের সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে সাথে নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। পর্যটন সমৃদ্ধ স্থানগুলো নিয়ে বাস্তবমুখী, দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে নোয়াখালী অঞ্চলকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জীবনমান উন্নয়ন এবং নিঝুম দ্বীপের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে অনন্য ভ‚মিকা রাখতে এই অঞ্চলে পর্যটনের বিস্তার একান্ত  প্রয়োজন।

সোহেল মো. নাফি
চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ,
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।
[email protected]

পর্যটন এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাষ্টিক: একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা
পরিবেশবান্ধব গ্রাহকসেবা দিতে চায় ওয়ালটন

আপনার মতামত লিখুন