বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
গাঁও গেরাম

টাঙ্গুয়ার হাওরের সংরক্ষিত এলাকা

পর্যটকের উৎপাতে দূষণ হুমকিতে প্রাণবৈচিত্র্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
১৩ অক্টোবর ২০১৯

বিশ্ব ঐতিহ্য টাঙ্গুয়ার হাওর প্রায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সংরক্ষিত এলাকায় অবাধে মাছ-পাখি শিকারের পাশপাশি নতুন উৎপাত শুরু করেছে পর্যটকরা। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় না নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল কিছু পর্যটক প্রকৃতিবিনাশী কাজ করছে। পর্যটকদের প্লাস্টিকের বর্জ্য, শব্দদূষণ এখন টাঙ্গুয়ায় নিয়মিত ঘটনা। এমনকি সচেতন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে উচ্চৈঃস্বরে মাইক বাজিয়ে হাওরের সংরক্ষিত এলাকায় আনন্দে মাততে দেখা গেছে। এসব কারণে হাওরে মাছ, পাখি, গাছসহ নানা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত শুক্রবার, শনিবারসহ ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১০ হাজার পর্যটক আসে টাঙ্গুয়ার হাওরে।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার ১৮টি মৌজা নিয়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওরে ৫২টি বিল আছে। ১৯৯৯ সালে হাওরটির আয়তন ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর ছিল। ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপে হাওরটির আয়তন প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর। ২০১৬ সালে ১৪৪টি পিলার বসিয়ে হাওরের সীমানা দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৯ সালে এ হাওরকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি সুন্দরবনের পর টাঙ্গুয়ার হাওরকে দেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকাভুক্ত করা হয়। ২০০৩ সালের নভেম্বর থেকে ইজারা প্রথা বিলোপ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সংরক্ষণে নামে। জেলা প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আনসার-পুলিশ দিয়ে হাওর পাহারা দিতে থাকে। এখন শুধু আনসাররাই পাহারায় আছে। তারা পাহারার নামে হাওরের বিভিন্ন এলাকায় মাছ ধরার সুযোগ দিচ্ছে চোরাই জেলেদের। ২০০৬ সাল থেকে প্রশাসনের সঙ্গে সুইস দাতা সংস্থা এসডিসি (সুইস এজেন্স ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন) পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড নেচারাল) টাঙ্গুয়ার হাওর সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি পরিচালনায় নামে। হাওরপারের ৭৬টি গ্রামে ৭৩টি মৎস্যজীবী সমিতি করে হাওরে তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। প্রকল্প শেষ হওয়ায় চলে গেছে আইইউসিএন। এরপর সমিতিগুলোকে সরকার সমবায়ের অধীনে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৬ সালে সংরক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়। ১৩ বছরের ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতি ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, জীববৈচিত্র্যের আরো ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ এই অঞ্চলের সুধীজনের।

২০১৫ সালে আইইউসিএন টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের রেড ডাটা বুক জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, হাওরটিতে ১৩৪ প্রজাতির মাছ, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২১৯ প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী পাখি, ২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, আট প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১০৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। হাওরে ১০৯টি জলাশয় কাগজে-কলমে থাকলেও ৫২টির অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

টাঙ্গুয়ার হাওর ৮৮টি গ্রামবেষ্টিত। গ্রামে বসবাসকারী প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মধ্যে ৩০ শতাংশ মৎস্যজীবী, ৬০ শতাংশ কৃষিজীবী এবং ১০ শতাংশ অন্যান্য। হাওরে রয়েছে ১২০টি কান্দা-জাঙ্গাল। ২০১১ সালের এক জরিপে হাওরে ৬৪ হাজার পাখি (৮৬ জাতের দেশি, ৮৩ জাতের বিদেশি) ছিল। ২০১৫ সালে প্রায় দুই লাখ অতিথি পাখি এসেছিল। ২০১৮ সালে বার্ডস ক্লাবের জরিপে মাত্র ৫০ হাজার অতিথি পাখি আসে।

২০১৩ সালের ৯ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে পর্যটন স্থাপনার জন্য ১০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক নান্দনিকতার কারণে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিক পরিচিতি পায়। ফলে পর্যটকের স্রোতও বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে সুরমা নদীতে আব্দুজ জহুর সেতু চালুর পরই সরাসরি তাহিরপুরে চলে যাচ্ছে পর্যটকরা। সেখানে যানবাহন রেখে হাওর ঘুরে বেড়ায় তারা। এখন শুক্রবার, শনিবারসহ ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে পর্যটকরা আসে।

সচেতন এলাকাবাসী জানিয়েছেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের অত্যাচার বাড়ছেই। তাদের ব্যবহৃত নানা বর্জ্য দূষণ ঘটাচ্ছে হাওরে। তারা প্লাস্টিকের থালা, পলিথিন, চিপস-চানাচুরের প্যাকেটসহ প্রকৃতিবিনাশী উপকরণ ছুড়ে ফেলে হাওরে। সেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা, স্পিডবোট নিয়ে ঢুকছে। অনেক পর্যটক সংরক্ষিত এলাকায় উচ্চৈঃশব্দে মাইকও বাজায়। এতে জলজ-স্থলজ জীবের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান পরিবেশবিদরা।

তাহিরপুরের পর্যটক বাবরুল হাসান বাবলু বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে সৌন্দর্য দেখতে এসে পর্যটকরা প্রাণ ও প্রকৃতির বিনাশ করছে। শব্দদূষণ ও কোলাহলের কারণে জীবজন্তু বিপদে পড়ছে। এভাবে চললে হাওর থেকে বিরল প্রাণী হারিয়ে যেতে পারে।

হাওরের প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর বিরল প্রাণবৈচিত্র্যের আধার। আস্তে আস্তে নানা আঘাতে এই প্রাণবৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। পর্যটকদের উৎপাতে ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের। সংরক্ষিত এলাকায় প্রকৃতিকে উৎপাত করা অনৈতিক। প্রশাসন সচেতন না হলে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাণবৈচিত্র্য প্রাণ হারাবে। টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণ প্রকল্পে নিয়োজিত সাবেক সংগঠন ইরার নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর এখন অরক্ষিত। পর্যটকরা আনন্দ করতে এসে সংরক্ষিত এলাকায় পরিবেশবিরোধী কাজ করছে। এগুলো করার অধিকার কারো নেই।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে যাঁরা যান তাঁদের অবশ্যই প্রকৃতি রক্ষা করে ঘোরাঘুরি করতে হবে। আমরা পর্যটকদের জন্য গাইডলাইন করার চেষ্টা করছি।’

জাপানে টাইফুনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা বিঘ্নিত
ডিমলায় তিস্তা সীড্স'র ডিলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত

আপনার মতামত লিখুন