মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

করোনা আক্রান্ত পর্যটন শিল্প

ড. মো. মামুন আশরাফী
৩১ মে ২০২০

করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বব্যাপী যে শিল্পটি সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে পর্যটন শিল্প। পৃথিবীর বহু দেশেই এখন পর্যটন শিল্প তাদের নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কোনো কোনো দেশের প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে পর্যটন শিল্প।

করোনার করাল আঘাতে সেসব দেশের পর্যটন শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও নানা কারণে পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠতে পারেনি এখনও, তবে এ দ্রুত বিকাশমান শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। তারা আজ একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন। তাই এ দুর্যোগের মুহূর্তে এ শিল্পের প্রতি সরকারের সদয় দৃষ্টি অত্যাবশ্যক।

দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ শুরু হয়েছে মূলত দুই দশকের কিছু বেশি সময় ধরে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে গত বিশ-পঁচিশ বছরে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সরকারি প্রণোদনা ছাড়াই শুধু বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সাহসী বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে এ শিল্প যতটুকু এগিয়েছে, তা বিস্ময়কর বললেও কম বলা হবে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহর, পর্যটন নগরী কক্সবাজার, হিমছড়ি, ইনানী, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চল তথা দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সাহসী উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশাল সমাহার।

করোনাভাইরাসের কারণে আজ হুমকির মুখে পড়েছে তাদের এ বিনিয়োগ। শুধু এ বিনিয়োগকারীরাই হুমকিতে পড়েছেন তা নয়; হুমকিতে পড়েছে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য অনেক খাত যেমন- এভিয়েশন, রেস্টুরেন্ট, থিম পার্ক, ক্রুজ, ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি, ট্রাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর ইত্যাদি। বস্তুত পর্যটন কোনো একক শিল্প নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক ও বহুমুখী শিল্প। এ খাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপরে উল্লেখিত বহু ধরনের শিল্প খাত, আর তাই এ শিল্পের উন্নয়ন মানে অন্য অনেক শিল্প এবং তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বহু মানুষ ও তাদের পরিবারের আর্থিক ও জীবনমানের উন্নয়ন, যারা অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে।

করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটন শিল্প সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে হয়তো সবার পরে। কারণ পর্যটন হল মূলত একটি বিলাসী ‘পণ্য’, যা কেবল মৌলিক চাহিদা মেটানোর পরই উপভোগ করা যায়। করোনার প্রভাবে দেশে দেশে অর্থনীতি দুর্বল হবে এবং মানুষের পক্ষে পর্যটনের মতো বিলাসী ‘পণ্য’ উপভোগ করাও হবে কষ্টসাধ্য। বিপুলসংখ্যক মানুষ এ ‘পণ্য’ সহসাই ক্রয় করবে না। ফলে খরচ মেটাতে না পেরে এভিয়েশন, হোটেল-রিসোর্ট, পর্যটন কেন্দ্র, ক্রুজ, ট্রান্সপোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেটর এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী প্রচুর কর্মচারী ছাঁটাই করবে। বেকার হয়ে পড়বে এ শিল্পে কর্মরত দেশের লাখ লাখ মানুষ। অনেকের ব্যবসাই হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে যারা ছোট এবং মাঠপর্যায়ে সেবা প্রদান করছেন।

প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের তথ্যানুযায়ী, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে জুন পর্যন্ত পর্যটন খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা এবং চাকরি হারাবেন ৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০ কর্মী। যদিও অবস্থাদৃষ্টে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, জুনের পরও করোনা সংকট প্রলম্বিত হতে পারে এবং ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যেতে পারে।

বিকাশমান এ শিল্প খাতকে সহযোগিতা দিতে প্রায় ১০ বছর আগে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড। এ বোর্ড এখন পর্যটন খাতের ব্যবসায়ী তথা পর্যটনপ্রেমীদের আশা-ভরসার স্থল। বিগত ১০ বছরে এ বোর্ড পর্যটন উন্নয়ন এবং ব্যবসায়ীদের পর্যটন কর্মকাণ্ডের উন্নয়নে সহযোগিতার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে করোনার ফলে পর্যটনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট দূরীভূত করতে তারা কী এবং কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করবেন।

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ছোট-বড় শিল্প ও সেবা খাতের জন্য প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যদিও এটি একটি আপৎকালীন ঋণ সহায়তা বলেই আমার মনে হয়। পর্যটনের স্টেকহোল্ডারদের জন্য এ ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যদি পর্যটন খাতের জন্য একটি নির্ধারিত অঙ্ক বরাদ্দ করে দেয়া হয়, যেভাবে গার্মেন্টস খাতকে দেয়া হয়েছে, তাহলে এ ঋণ সহায়তা পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।

আর যারা মাঠ পর্যায়ের সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ট্রাভেল এজেন্ট ও ট্যুর অপারেটর, তাদের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ ঋণ সহায়তা হিসেবে বরাদ্দ করা হলে এর সুফল পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ব্যাংকগুলো এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে।

সময় পাল্টেছে, মানুষের আচরণ পাল্টেছে, তাই পর্যটন সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি আরও আধুনিক করতে হবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরাই যেন এ সহায়তা পান এবং তা তাদের টিকে থাকার জন্য ব্যয় করেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ ঋণ সহায়তার অপব্যবহার সরকারের সৎ উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।

তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে স্মরণকালের সবচেয়ে গভীর সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাখ লাখ পরিবারকে ভালোভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের এ ঋণ সহায়তা দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব হ্রাস এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং এর ফলে সরকারের ওপর চাপ অনেক কমবে।

লেখক : পর্যটন বিশেষজ্ঞ

[email protected]

৩ মাস বাড়াল সৌদির পর্যটন ভিসার মেয়াদ
যেভাবে ব্যবসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে থাই পর্যটন শিল্প

আপনার মতামত লিখুন