মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫ | ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
মতামত

পরিকল্পিত পর্যটন শিল্প ও পদ্মা সেতু

মীর মাহফুজুর রহমান
০৪ জুলাই ২০২২

পদ্মা সেতুকে নিয়ে আজ প্রতিটি দেশবাসীর গর্ব হচ্ছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে যার অবদান সবচেয়ে বেশি; দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মহলের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে, যার দূরদর্শী নেতৃত্বে এই স্বপ্ন জয়ের পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন আজ দৃশ্যমান সেই গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মাদার অব হিউম্যানিটি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। 

শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। পদ্মা সেতুর মত আরও ডজনখানেক মেগা-প্রজেক্ট এ বছরই বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের ভীত কতটা শক্ত, তা এসব মেগা-প্রজেক্ট বাস্তবায়নের চিত্র দেখলেই বুঝা যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণে সেই উত্তাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। আসলেই তো, এ কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর একটি সফল অর্জন এটাই প্রমাণ করে বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানি, দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে পদ্মার বুকে দণ্ডায়মান অবাক বিস্ময়, স্বপ্ন জয়ের উপাখ্যান, আমাদের পদ্মা সেতু। 

 স্বাধীন দেশে চোখে পড়ার মত বড় কোনও অর্জন যদি বাঙালি জাতি দেখে থাকে তা হল পদ্মা সেতু। আমাদের স্বপ্নের সেতু। কিন্তু আমি বলব, পদ্মা সেতু হল স্বপ্ন জয়ের সেতু। দুর্গম পথের সকল কঠিন বাধা পাড়ি দিয়ে ধুসর বর্ণের পদ্মা সেতু আজ দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কোটি বাঙালির গর্ব হয়ে। দেশের ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের গল্প বলবে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু কি শুধু পারাপারের সেতুবন্ধনের নিমিত্তে তৈরি? আর কি কিছু চোখে পড়ছে না? বাংলাদেশের জিডিপিতে ১৪% ভূমিকা রাখে যে খাতটি সেই খাতের অপার সম্ভাবনার সোপান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পদ্মা সেতু। এ সেতু পর্যটন শিল্পের বিকাশে এক শক্ত অবস্থান রাখবে বলে আমি মনে করি। 

অনেকে বলছেন, পদ্মাপাড়ে গড়ে উঠবে হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, তাত পল্লী, যাদুঘরসহ আরও কত কী! কিন্তু পর্যটন শিল্পকে সঠিক ও পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার ওপরই ভিত্তি করে এ শিল্পের সফলতা। ওখানে হতে পারে আন্তর্জাতিক মানের সব পাঁচতারকা হোটেলসহ বিনোদনকেন্দ্র। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে আছে কনকর্ড গ্রুপের ‘ফ্যান্টাসি কিংডম’ ও চট্টগ্রামে অবস্থিত ‘ফয়েস লেক’। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটকদের জন্যও আমরা সমমানের বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন করতে পারি যেখানে একজন পর্যটক পাবে থাকা, খাওয়াসহ বিনোদনের সকল সুবিধা।

স্বাধীনতা পরবর্তী নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের সব জাতিই ছিল শঙ্কিত। ভোখা, নাংগা এই দেশের মানুষের অর্থনীতির সূচক ছিল শূন্যের কোঠায়। বন্যা, খরা আর জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই পরিচিত ছিল বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে আমরা আজ অর্থনীতিতে এশিয়ান টাইগার তথা ইমার্জিং টাইগার। বাঘের মত গর্জে উঠছে আমাদের অর্থনীতি পৃথিবীর সকল দেশকে টেক্কা দিয়ে। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনার এই দেশে, আমরা এখনও এই খাতটিতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত তেমন সুবিধা করতে পারছি না। অথচ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত একজন পরিব্রাজকের কাছে মনকাড়া দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই। 

আমাদের পদ্মা সেতু পর্যটন শিল্প বিকাশের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিল বহুগুণ। পর্যটন উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা বা অন্তরায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তাহীনতা। পদ্মা সেতুর কারণে যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তাই এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন অনিবার্য। তাই পদ্মা সেতুর কারণে দেশের পর্যটন শিল্পের গতিধারা বদলে যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করতে পর্যটন শিল্পকে তাদের ব্যবসায়ীক হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। অথচ পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা এই শিল্পের বিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি না। আজ পদ্মা সেতু আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা আজ ভাবতেই পারি, বাংলাদেশ হবে এশিয়ার অন্যতম টুরিস্ট প্যারাডাইজ। 

আমাদের দেশের অধিকাংশ পর্যটন শিল্পই প্রকৃতি নির্ভর। সমুদ্র, পাহাড় আর বনাঞ্চলে ভরপুর পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঠিক যেভাবে পরিকল্পিতভাবে পর্যটকবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলার দরকার ছিল, সেই পরিকল্পনামাফিক হয়নি বলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ খাত থেকে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, সিলেট আর রাঙামাটিকে পর্যটকেরা যেভাবে ডেসটিনেশন গোল হিসাবে মনে করে, সেভাবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানকে আমরা একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অভাবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকৃষ্ট করতে পারিনি। ভারতের যেমন আছে পর্যটন সিটি ‘গোয়া’, আমরাও পারি অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা পটুয়াখালীকে দক্ষিণের পর্যটন শহর বানাতে। 

একপর্যটন খাত থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণের মানুষের জীবন-জীবিকার ভাগ্য বদল ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসতে পারে পদ্মা সেতুর বদৌলতে। এজন্য দরকার সরকারের এ শিল্পের প্রতি সুদৃষ্টি ও দূরদর্শী মহাপরিকল্পনা। তাহলে দেশের মোট জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধি অর্জন ৩০ শতাংশে উন্নীত হতে হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বোৎকৃষ্ট সংযোজন পদ্মা সেতু। ভাগ্য বদলে দেওয়া এই সেতু দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। 

বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র যেন পদ্মা সেতু দিয়েই শুরু হল। এ বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে দেখতে যারা আসবেন তারাই হলেন বাংলাদেশে ঘুরতে আসা পর্যটক। তারাই আমার দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বাহক৷ যে দেশে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের মত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আছে। যে দেশে নকশীকাঁথা আছে, যেদেশে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে। যেদেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আছে সেদেশে পর্যটন বিকাশ অবধারিত। দরকার ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার প্রভূত উন্নতি। তা পদ্মা সেতুর মাধ্যমেই সাধিত হয়েছে।

পরিবেশ, প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থান, এই তিন ‘প’-এর সমন্বয়ে স্থাপনানির্ভর পর্যটন শিল্প গড়ে উঠে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার কিংবা লন্ডনের টেমস নদীর স্থাপনা দেখতে যাওয়া একজন পর্যটকের মূল ডেসটিনেশন থাকে। আমাদের পদ্মা সেতুকেও সেই রকম একটা গ্লোবাল ব্র‍্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করতে হবে। এটি যে একটি শ্রেষ্ঠ ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ান্ডার’ সেটি বিশ্ববাসীকে জানান দিতে হবে। 

শোনা যাচ্ছে, পদ্মা সেতু ট্রান্স এশিয়ান এক্সপ্রেস হাইওয়ে রুটের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এটি তখন ভারত, চীন, ইরান হয়ে ইউরোপে গন্তব্য হবে। ট্রেনে করে ইউরোপের যাত্রীরা নামবে শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতু দেখতে। তাহলে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের এক বিশাল গেটওয়ে হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। 

বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের হাতছানি আমরা দেখতে পাচ্ছি পদ্মা সেতুর কারণে। পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু দাঁড় করানো যেমন ছিল কোটি বাঙালির স্বপ্ন; তেমনি সেতু চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন বিকাশের স্বপ্নও আমাদের তাড়া করছে। 

ভারীশিল্প, প্রবাসীদের রেমিট‌্যান্স বা পোশাকশিল্পের সাথে এক কাতারে পর্যটন শিল্পকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক শক্তি হিসাবে দেখতে চাইলে এখনই এর একটি মেগা প্ল্যান দরকার। ভৌতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এই খাতে দক্ষ জনবল তৈরিও একটি কি-ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এর মধ্যে দেশের ১১শ’ স্পট নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার আর্কিটেকচারাল, স্ট্রাকচারাল ও ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানও রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনার পর্যটন স্পটগুলো অগ্রাধিকার পাবে। যদি এর সঠিক বাস্তবায়ন ঘটে তাহলে পর্যটন শিল্পের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ সুপ্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। 

ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বা দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফাকে পর্যটকরা দেখতে যেভাবে আকৃষ্ট হয়, ঠিক সেভাবে পদ্মা সেতুকেও আকৃষ্ট করানোর জন্য এর একটি সঠিক ও যুগোপযোগী ব্র‍্যান্ডিং বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে হবে। দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ শুধু পর্যটন সুবিধা বাড়িয়ে যেমন তার পর্যটনশিল্পকে দেশের একমাত্র প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির খাত হিসেবে এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে আছে; ঠিক তেমনি আমাদেরও সেই অবস্থানে আসার সময় এসেছে। দরকার সঠিক সুপরিকল্পনা, বৃহদাকারে পর্যটন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায়। 

বাংলাদেশের টুরিস্ট স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় ও নয়নাভিরাম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি, যাতে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যটক আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। 

একমাত্র পর্যটনশিল্পে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় কোন বৈশ্বিক মন্দা দেখা না দিলে এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তেজীহারে বাড়তে থাকে লাগামহীন ঘোড়ার মত। 

পর্যটন শিল্পের বিকাশ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে পদ্মা সেতুর মতই বিশ্ববাসীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্পের ভীত গড়ে তুলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। 

পরিশেষে, ধুসর বর্ণের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনীতিতে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। এই স্বপ্নের সেতু আগামী দিনের বাংলাদেশকে এক গর্বিত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবে। স্বপ্ন জয়ের এই সেতু বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশেষভাবে কার্যকরী। দক্ষিণাঞ্চল তথা বাংলাদেশের উদীয়মান বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে আশা করি।

লেখক: মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব এমিউজমেন্ট পার্ক অ‌্যান্ড এটরাকশন্স (বাপা)।

ছনখোলা থেকে পর্যটন
উন্নত কর্মপরিবেশ, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় ‘রোসপা গোল্ড অ্যাওয়ার্ড’ পেলো ওয়ালটন

আপনার মতামত লিখুন