শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মতামত

পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে গতিশীল হোক অর্থনীতি

বীরেন মুখার্জী
২০ মার্চ ২০২২

মানুষের মন যেমন বৈচিত্র্যসন্ধানী, তেমনি ভ্রমণপিয়াসি। ভ্রমণ একধরনের ‘বিলাস’ও বটে। ভ্রমণপিপাসু কোটি কোটি মানুষ রয়েছে বিশ্ব জুড়ে, যারা কর্মময় জীবনের ক্লান্িত নিরসনে কিংবা নিতান্তই শখের বশে পরিবার-পরিজনসহ কিংবা এককভাবে ঘুরে বেড়ান। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ বাংলাদেশে রয়েছে পর্যটনের নানা স্থান। পর্যটন খাতও এ দেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন মার্কেটের মধ্যে বাংলাদেশকে উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ পর্যটন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৫ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে এসেছিল। এ সময় বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ভ্রমণে গিয়েছেন ১৩ লাখ মানুষ। পাশাপাশি দেশের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ।

অস্বীকারের সুযোগ নেই, সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বহুলাংশে বেড়েছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথ পরিক্রম করছে। এ কারণেও পর্যটনশিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করার ওপর জোর দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। পর্যটন এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত বিনোদন-বিকাশের সুযোগ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পর্যটন এলাকায় হোটেল বৃদ্ধি এবং পর্যটনক্ষেত্রে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারলে নবদিগন্েতর সূচনা হতে পারে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের। তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫, তাইওয়ানের ৬৫, হংকংয়ের ৫৫, ফিলিপাইনের ৫০ এবং থাইল্যান্ডের ৩০ শতাংশ পর্যটনের অবদান। এছাড়া মালদ্বীপের জাতীয় অর্থনীতির অধিকাংশ এবং মালয়েশিয়ার জিডিপির ৭ শতাংশ পর্যটনশিল্পের অবদান। কাজেই যেকোনো দেশের জন্য পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগ একটি লাভজনক বিষয়।

গবেষকদের মতে, যেকোনো বর্ধনশীল আয়ের রপ্তানি বাণিজ্যের চেয়েও বেশি লাভজনক এই পর্যটনশিল্প। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এই শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে দেশীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু এগিয়েছে, তা খতিয়ে দেখেই এই শিল্পের উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্হা গ্রহণ করা দরকার। পর্যটনকে বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেননা, পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর যেমন পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকেও প্রচুর রাজস্ব আয় হয়ে থাকে, যে কারণে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উত্স হিসেবে পর্যটনশিল্পকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্হার প্রাক্কলন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তথ্যমতে, বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৩ লাখ। অর্থাত্, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্হানের ব্যবস্হা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলে এই খাতে কর্মসংস্হান বৃদ্ধিসহ প্রচুর মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বাজেটে অর্থ বাড়িয়ে এই শিল্পের উন্নয়নে টেকসই প্রকল্প গ্রহণ করা হলে তা সামগ্রিক উন্নয়কে ত্বরান্বিত করবে। পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল—এমন মতও রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।

বিশ্বব্যাপী পর্যটনশিল্পের প্রসার প্রমাণ করে, প্রকৃতির কাছ থেকে চিত্তবিনোদনের ও জ্ঞানের পাঠ নেওয়ার প্রতি মানুষের ঝোঁক দিনে দিনে বাড়ছে। এ জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করা বা তাদের আহার ও বাসস্হানের সংস্হান, চিত্তবিনোদন ইত্যাদির নিশ্চয়তা প্রদানের ব্যবস্হা করতে হবে। একটু ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যায়, সুদূর অতীতেও বিশ্বের নানা অংশ থেকে পর্যটকেরা বাংলা ভ্রমণ করেছেন। কেউ এসেছেন ধর্ম প্রচারে, কেউ ব্যবসার উদ্দেশ্যে, কেউ প্রাচীন বাংলার নানা জ্ঞানপীঠ থেকে বিদ্যার সন্ধানে, আবার কেউ শুধুই কৌতূহল নিরসনে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, এরকম কয়েক জন পর্যটকের মধ্যে রয়েছেন গ্রিসের প্লিনি দ্য এল্ডার (তিনি এসেছিলেন তাম্রলিপ্তিতে, প্রথম শতকে), মিসরের ক্লডিয়াস টলেমায়েস টলেমি (গঙ্গারিডাই বা গৌয়, দ্বিতীয় শতক), চীনের ফা-হিয়েন (তাম্রলিপ্তি, পঞ্চম শতক) ও হিউয়েন-সাং (মহাস্হান, সমতট, কর্ণসুবর্ণ ও তাম্রলিপ্তি, সপ্তম শতক), মরক্কোর ইবনে বতুতা (চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁও, ১৪শ শতক), চীনের মা হুয়ান (গৌড়, ১৫শ শতক)) ও ফেই সিন (চট্টগ্রাম ও সোনারগাঁও, ১৫শ শতক), পতু‌র্গালের দুয়ার্তে বারবোসা (গঙ্গা অববাহিকা, ১৬শ শতক), ইতালির সিজার ফ্রেডেরিক (চট্টগ্রাম, ১৭শ শতক), ইংল্যান্ডের র্যলফ ফিচ (চট্টগ্রাম, ১৬শ শতক), ইতালির নিকোলা মানুচি (ঢাকা, ১৭শ শতক) এবং ফ্রান্সের জে.বি টেভার্নিয়ার (ঢাকা, ১৭শ শতক)। ফলে এ কথা বলা যেতেই পারে যে, বাংলাদেশকে পর্যটকের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে নিতে হলে এই খাতের আধুনিকায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্হান অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ সুবিধাজনক অবস্হানে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্হান ‘ম্যাক্রো-এশিয়াটিক এয়ার ট্রাফিক’ করিডরে থাকায় বিশ্বের নানা দেশ থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আগত পর্যটকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট করা তুলনামূলকভাবে সহজ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ আকর্ষণ পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, অনুপম সমুদ্র বেলাভূমি কুয়াকাটা, বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, ঝুলন্ত সেতু, বগা লেক, চা-বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর, সিলেটের জাফলং, আহসান মঞ্জিল, ষাটগম্বুজ মসজিদ, হামহাম বা শেরপুরের ঝিনাইগাতি, নকলা বা গজনী ইত্যাদি। এছাড়া এ দেশের শ্যামল-সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদনদী, বনভূমি, পাহাড়ি অঞ্চল, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন স্হান, বাঙালির আচার-অনুষ্ঠান, লোকসংস্কৃতি, প্রত্নতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক জীবন—সবই পর্যটক আকর্ষণের মাধ্যম। এছাড়া পর্যটনসমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্হানসমূহের মধ্যে আমাদের আরও রয়েছে :প্রাচীন মসজিদ, বৌদ্ধবিহার, মন্দির, সাধারণ বসতি, আবাসিক গৃহ, নহবতখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জমিদার প্রাসাদ, মুদ্রা, প্রাচীন পুঁথি, পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পাথরের ভাস্কর্য, মৃত্পাত্র ইত্যাদি।

এ কথা ঠিক যে, পর্যটনের সঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। দায়িত্ব রয়েছে বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের। স্হানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ও দায়িত্বের কথাও অস্বীকার করা যাবে না। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে পর্যটনের জন্য বাস্তবধর্মী নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি বলে মনে হয়। আমাদের দেশে পর্যটন করপোরেশন ও টু্যরিজম বোর্ড রয়েছে। বাংলাদেশ টু্যর অপারেটর ও টু্যর গাইড (নিবন্ধন ও পরিচালনা) বিল ২০২১ নামে পর্যটনশিল্প ও পর্যটকদের স্বার্থ সংরক্ষণে নতুন একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। এটি অত্যন্ত আশার কথা।

মানুষের ভ্রমণবিলাস একটি দেশের আয়ের উল্লেখযোগ্য উত্স হয়ে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে। একুশ শতককে বিশ্বব্যাপীই পর্যটনের স্বর্ণ সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে দেশে দেশে যাতায়াতব্যবস্হা সহজ হয়েছে। অবারিত হয়ে পড়েছে সপরিবারে ভ্রমণ। উন্নত বিশ্বের পর্যটকদের কাছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব লাভ করছে। প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলে প্রকৃতিনির্ভর জীবন পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ফলে এই শিল্পের পরিকল্পিত বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, পুরাকীর্তি ও প্রত্নতত্ত্ব, ক্ষুদ্র জাতীগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা ইত্যাদি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে নিসর্গমণ্ডিত হওয়ায় শুধু দেশি নয়, বিদেশি পর্যটকদের জন্যও আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। যুগ যুগ ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করায় বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। ‘বাংলাদেশ যদি পর্যটনের বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরে বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা’—বিশেষজ্ঞদের এমন মতামত অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সংবাদকর্মী।

আমার ঈশ্বর জানে
ফের চালু হচ্ছে নীল দিগন্ত পর্যটনকেন্দ্র

আপনার মতামত লিখুন