বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
উদয় হাকিমের ভ্রমণ কাহিনী

আয়ারল্যান্ডের ভিসা পাওয়া এত সহজ! পর্ব ২

উদয় হাকিম, ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড) থেকে ফিরে
১৩ জুন ২০১৯
দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ডাক্তার ইকবালের সঙ্গে সেলফি

দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ডাক্তার ইকবালের সঙ্গে সেলফি

২০১৭ সালের কথা বলছিলাম। যে বার মাত্র দুই ঘণ্টায় আয়ারল্যান্ডের ভিসা পেয়েছিলাম। ভিসার জন্য দিল্লি যাচ্ছিলাম জেট এয়ারের ফ্লাইটে।

ঢাকা এয়ারপোর্টে বোর্ডিং লাউঞ্জে দেখা হয়ে গেলো ডাক্তার ইকবাল কবিরের সঙ্গে। বহুদিন পর এই মানুষটার সঙ্গে দেখা। পৃথিবীতে কিছু কিছু মুখ আছে যেগুলো দেখা মানে একেকটা স্বর্গ দর্শন। আমার কাছে ইকবাল কবিরও তাই। সবসময় হাসি খুশি। কখনোই তাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখিনি। কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে নিজের মতো করে ব্যখ্যা করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। ডাক্তারতো আসলে এরকমই হওয়া উচিত। তাকে দেখলেই রোগ অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। ডাক্তার দেবী শেঠীকে অনেকে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেন; আমি বলব বাংলাদেশের দেবী শেঠী ডাক্তার ইকবাল। যাদের মনে হবে আমি বাড়িয়ে বলছি, তারা একবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।

যাক, ধান ভানতে শীবের গীত এসে যাচ্ছে। কিন্তু পরম্পরা না বললে কাহিনী এগোবে কেমনে। দূর থেকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, আরে উদয় হাকিম আপনি এখানে! অবাক আমিও। ডাক্তার আপনি এখানে! কোথায় যাচ্ছেন? দিল্লি। কেন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেমিনারে যোগ দিতে। আপনি কেন যাচ্ছেন? বললাম, আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় ক্রিকেট হচ্ছে। বাংলাদেশ দল চলে গেছে। সিরিজে ওয়ালটন টাইটেল স্পন্সর। ওয়ালটনের প্রতিনিধি হিসেবে ওখানে যাব। কিন্তু ভিসা হয়নি এখনো। দিল্লি যাচ্ছি। ভিসা ম্যানেজ করতে পারলে ডাবলিন যাব। না হলে দিল্লি থেকে ফিরে আসব।

চলেন দেখি কী হয়। হাসতে হাসতে বললেন ইকবাল কবির। কোন হোটেলে উঠবেন। বুকিং কোথায়? বললাম, হোটেল বুকিং দিইনি। আগে গিয়ে দেখি।

শুনেছি দিল্লির সব দূতাবাস চাণক্যপুরীতে। নামটা ভীষণ টানলো আমাকে। নীতিবাক্যের গুরু বলা হয় চাণক্যকে। তার নামানুসারেই কি না। নামটা শুনলেই মনে হয় কোনো এক রূপকথার কল্পরাজ্য সেটা। কিন্তু চাণক্যপুরীতে নাকি কোনো হোটেল নেই। সব বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতাবাস। অভিজাত এলাকা।

এর কাছাকাছি শহর পাহাড়গঞ্জ। পরিচিত এক বড় ভাই স্বাধীন। বলে দিয়েছিলেন, চাণক্যপুরীর পাশেই পাহাড়গঞ্জ। সেখানে অনেক হোটেল আছে। আগে থেকে বুকিং দেয়ার দরকার নেই। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। চলে যান।

ডাক্তার ইকবাল প্রস্তাব দিলেন, তার সঙ্গে থাকতে। উনি লা মেরিডিয়ানে উঠবেন। আগে থেকেই বুকিং দেয়া। দুইজনের কক্ষ। আপনার যদি আপত্তি না থাকে।

ভাবলাম, লা মেরিডিয়ান নিঃসন্দেহে ভালো হোটেল। সেটা নাকি চাণক্যপুরীর সবচেয়ে কাছে। তাহলে সমস্যা কী। রাজি হয়ে গেলাম।

দিল্লি নেমে একসঙ্গে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করলাম। হোটেল থেকে গাড়ি গিয়েছিলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিও ছিলেন। ডাক্তার ইকবাল হিন্দিতে কথা বলে খুব অল্প সময়েই তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেন। আমি হিন্দি বুঝিনা। তাই চুপ। এটা একটা কৌশল। বিদেশি মানুষের মুখে কেউ যদি বাংলা শুনে। নিশ্চয় সে খুশি হবে। সঙ্গে একটু বাড়তি খাতির পাবে। ডা. ইকবাল ড্রাইভারকে বললেন, তোমাকে একটু কষ্ট দেব। তাড়া আছে কি না। ড্রাইভার বললো, কোনো সমস্যা নেই স্যার। ওকে, তাহলে তুমি আমাদের চাণক্যপুরীতে বাংলাদেশের দূতাবাসে নিয়ে চলো। পরে হোটেলে যাব।

প্রথম টের পেলাম দিল্লিতে অনেক গরম। অনেকটা দুবাইয়ের মতোই। গাছপালা কম। এয়ারপোর্ট থেকে চাণক্যপুরী যাওয়ার পথে রাস্তার দুধারে মরুভূমির মতো ছোট ছোট গাছগাছড়া। তবে উড়োজাহাজ থেকে দেখেছিলাম সবুজ গাছপালা। নিশ্চয় সেগুলো আছে অন্যদিকে।

অল্প সময়েরই মধ্যেই চাণক্যপুরীতে চলে গেলাম। ঢাকার বারিধারা দূতাবাস এলাকা যেমন, অন্য এলাকার চেয়ে বেশি সুন্দর; তেমনটা সেখানেও। স্বীকার করতেই হবে দিল্লির দূতাবাস এলাকা আরো বেশি সুন্দর। ড্রাইভার ভালোই চেনেন এলাকা। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের নিয়ে গেলেন বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে। ইপি-৩৯, ড. এস রাধাকৃষ্ণ মার্গে। মার্গ শব্দটা কেউ কেউ না-ও বুঝতে পারেন। মার্গ মানে মর্গ নয়! এর অর্থ চিহ্ন, পথ, মনে রাখার মতো কিছু।

পথে ইকবাল কবির জিজ্ঞেস করেছিলেন ফরিদ হোসেন ভাইকে চিনি কি না। এপির ফরিদ ভাই (অ্যাসোসিয়েট প্রেসে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন)। কেন চিনব না। বাংলাদেশের অনেক লোকেই তাকে চেনেন। অনেক টকশোতে গেস্ট ছিলেন। বিশেষ করে সাংবাদিকরা সবাই চেনেন। সাংবাদিকতার উপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণে তিনি শিক্ষক হিসেবে থেকেছেন। সদালাপী এবং সজ্জন মানুষ। নিপাট ভদ্রলোক। ফরিদ ভাই আছেন দিল্লির বাংলাদেশ হাই কমিশনে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে। ডাক্তারের কছে ফরিদ ভাইয়ের মোবাইল নম্বর ছিলো। লোকাল সিমও ছিলো। তিনি কথা বললেন ফরিদ ভাইয়ের সঙ্গে। বলিয়ে দিলেন আমাকেও। সালাম দিলাম। জানালাম আসছি।

বাংলাদেশ হাই কমিশন ভবন অনেক বড়। সুন্দর, গোছানো। রিসিপশনে বলা ছিলো। সরাসরি চলে গেলাম দোতলায়। ফরিদ ভাইয়ের কক্ষে। সঙ্গে একটা মগ, মানিব্যাগ এবং আমার লেখা বই ‘সুন্দরী জেলেকন্যা ও রহস্যময় গুহা’ নিয়ে গিয়েছিলাম। ফরিদ ভাইয়ের হাতে দিলাম। কোলাকুলি করলাম। মানুষটা খুব আন্তরিক। মুখ দেখে বুঝলাম, আমাদেরকে পেয়ে তিনিও খুশি।

ফরিদ ভাইকে জানালাম কেন দিল্লি গিয়েছিলাম। বললেন, এতো অল্প সময়ে ক্যামনে ভিসা পাবেন? অসম্ভবই মনে হচ্ছে। সন্ধ্যায় ডিপ্লোম্যাট ক্লাবে মাঝে মাঝে অ্যাম্বাসির লোকদের সঙ্গে দেখা হয়।  যদি দেখা হয় বলে দেব। ভাবছিলাম, আর কোনো উপায় না পেলে ফরিদ ভাইকে দিয়ে একটা হিল্লে করতে হবে।

সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম। ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম আয়ারল্যান্ড অ্যাম্বাসিতে যেতে।  যেটা চাণক্যপুরীর সি ১৭, মালচা মার্গে। ড্রাইভার চেনে বলে রক্ষা। না হলে এটা বের করা খানিকটা মুশকিলই। অপেক্ষাকৃত সরু একটা রোডের ভেতরে। পাশেই একটা পার্ক। সেখানে কিছু বেঞ্চ আছে। দুপুর গড়িয়ে ততক্ষণে বিকেল। রোদের উত্তাপ বেড়েছে। এসময়ে পার্কে কে আর বসবে। গরম হাওয়া বইছিলো। দাবদাহের মতোই।

দূতাবাসের গেট বন্ধ। এমন করে বন্ধ যেন অনেক দিন সেটা খোলা হয় না। গেটও ছোট। একটা দূতাবাসের সদর দরজা আরেকটু বড় হলেও পারতো। একটা পকেট গেট আছে বলে অনুমান করা যাচ্ছিলো। সেখান দিয়েই হয়তো দূতাবাসের কর্মকর্তারা আসা যাওয়া করেন। কিন্তু সেটাও বন্ধ। শুনশান নীরবতা। একটা অফিস বা দূতাবাস এতো নীরব। ভাবাই যায় না। পোড়ো বাড়ির মতো নিস্তব্ধতা।

বাইরে গেটের অনেকটা দূরে টং ঘরের মতো একটা অতি ছোট্ট ছাউনি। সেখানে ফরসা লম্বা এক আদমি বসা। উর্দি পরা। মাথায় জলপাই কালারের টুপি। ধারণা করছিলাম আয়ারল্যান্ডের লোকটা। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করছিলাম ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে। জানতে চাইছিলেন কোন দেশ থেকে গিয়েছি। বাংলাদেশ। বললেন, এখানে না। কাগজ জমা দিতে হবে কোলকাতায়। দিল্লিতে বাংলাদেশের কোনো আবেদন নেয়া হয় না। আর দিল্লিতে যারা আবেদন দিতে পারেন তাদেরও কাগজপত্র দিতে হয় কুরিয়ারে। ডিএইচএলের মাধ্যমে। আপনারা বাইরে গিয়ে কুরিয়ার করতে পারেন।

মহা ঝামেলা দেখছিলাম। বুঝেছিলাম, সে যাত্রায় আয়ারল্যান্ড যাওয়া হবে না।

বললাম এটা স্পেশাল কেইস। আমাদের ভেতরে যেতে হবে। ডাক্তার ইকবাল দেখলাম হিন্দি বলে তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছেন। লোকটি পরামর্শ দিলেন আজ সময় শেষ। কাল সকালে আসুন।

ভাবছিলাম তখনই একটা সুরাহা করতে। যত দেরি তত সম্ভাবনা কম। এতো বড় রিস্ক নিয়ে যাওয়া ঠিক হয় নাই মনে হলো। যাক, রিস্ক আর কী। হলো হলো। না হলে চলে যাব।

পরের বার কথা বলতে গিয়ে দেখলাম দাড়োয়ান লোকটার ইংরেজি ইন্ডিয়ানদের মতোই। তার মানে দেখতে যাই হোক মাল ইন্ডিয়ান। কিন্তু লোকটা এতো কঠিন কেন? অনুরোধ করলাম ভেতরে গিয়ে কারো সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে। অন্তত ভেতরে একটা খবর দিতে। অথবা অন্য একটা উপায় বলে দিক। কিন্তু না, তার এক কথা, পরের দিন আসুন। এও বললেন, এখান থেকে ভিসা হবে না।

আমারতো ভিসা নিতেই হবে। না হলে ম্যান অব দি ম্যাচের পুরস্কার দেবে কে?

আয়ারল্যান্ডের ভিসা পাওয়া এত সহজ! প্রথম পর্ব

রাইজিংবিডির উপদেষ্টা সম্পাদক হলেন উদয় হাকিম
আয়ারল্যান্ডের ভিসা পাওয়া এতো সহজ! পর্ব ৩

আপনার মতামত লিখুন